Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

উপজেলার পটভূমি

তানোর থানা গঠিত হয় ১৮৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে। রাজশাহী জেলার উত্তর-পশ্চিম কোণে জেলা শহর থেকে ৩০ কিঃ মিঃ দূরে শিবনদী এবং বিলকুমারীর পশ্চিমপাড়ে বরেন্দ্রভূমির প্রাণকেন্দ্র এ তানোর উপজেলা । ‘তানোর ’ শব্দটি তানর হতে উদ্ভুত । ‘ তানর ’ অর্থ তান-রহিত অর্থ্যাৎ জীবন-স্পন্দনহীন, নিস্প্রভ ও নিরানন্দ জনপদ। পুরাকালে গাছপালাহীন মরুপ্রায় এ অঞ্চলে জনপদ বলতে তেমন কিছুই ছিলনা । কালের আবর্তে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে আজকের এ জনপদ ‘তানোর ’ যা একটি শস্যশ্যামল খাদ্য ভান্ডার বিশেষ । এখানে অনেকগুলো আদিবাসী গ্রাম রয়েছে এবং তারা এখানে স্বাচ্ছন্দে বসবাস করে।

 

তানোরের ইতিহাস: আদিপর্ব

 

তানোর শব্দের বা নামের উৎপত্তি কীভাবে হলো তা সঠিকভাবে বলা যায় না। হতে পারে  তানোর এসেছে সংস্কৃত তানব (তানোব) শব্দ থেকে। তানব শব্দের অর্থ করলে দাঁড়ায় তনুতা, কৃশতা বা সূক্ষণতা। বরেন্দ্রর রুক্ষতা বা সুক্ষ্ণতা বা কৃশতা হচ্ছে তানোরের প্রকৃতির এক সময়ের পরিচিত উদাহরণ। এসব বিবেচনায় কেউ বলতে পারেন, তানোর এসেছে তানব (তানোব) শব্দ থেকে। অন্যদিকে তানোর শব্দটাকে ভাঙলে এর আনুমানিক একটা উৎস খোঁজা যেতে পারে। তানোর শব্দকে আমরা দুইভাবে ভাঙতে পারি। যেমন: তা + নর; অথবা তান + র। প্রথমটির ক্ষেত্রে, তা মানে পাক, মোচড় বা কোঁকড়ানো। ( যেমন গোঁফে তা দেওয়া)। আর নর মানে মানব বা মানুষ। হতে পারে এক সময় গোঁফ পাকানো বা কোঁকড়ানো চুল সম্পন্ন মানুষের বাস ছিল এই ভূখন্ড। এ থেকে এই এলাকার নাম হতে পারে তানোর। এখানে উল্লেখ্য যে, তানোরের সাথে পাক খাওয়া বা কোঁকড়ানো চুলওয়ালা মানুষের (সাঁওতাল) একটা পুরাতন সখ্যতা আছে। এবার দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দেখব: তান মানে হলো সঙ্গীতের স্বর বা রাগ, সুরের আলাপ, সুর কিংবা সুরেলা ধ্বনি। আর র  মানে হলো, থামা বা থামিয়ে দেয়া। কথিত আছে যে, এক সময় এই অঞ্চলের মানুষ ছিল খুবই আমুদে। নাচ-গান ছিল তাদের নিত্যদিনের  মানসিক ও শারীরিক অবসাদ দূর করবার  মাধ্যম। কোন এক সময় বেনিয়া শাসকগোষ্ঠী এসে হঠাৎ করে তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেয়। একটা সত্মব্ধতা নেমে আসে সারা এলাকা জুড়ে। আর সেখান থেকেই আসে তানোর নাম। শেষোক্ত মতটি ব্যক্ত করেছেন প্রবীন শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ (অব) নারায়ন চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি এক পুসিত্মকায় বলেছেন:

Since the place was totally uninhabeted by civilized people and was infested by pirates only and bloodshed and wailing of human victims was the common picture of the area, joy and happiness were totally absent; and hence the derivation of the word `Tanore’. The word `Tanore’ in Bengali is most probably the distorted from of the original word `Tan’ meaning rhythm or harmony and `Ro’ the shortened from the `Rohit’ meaning stopped or banished. In course of time the original words `Tan-Ro’ Might have been Changed while being pronounced by different people and assumed the from `Tanor’ or `Tanore’.*                                                                                                                                                

তবে গবেষক ড. মোহাম্মদ আমীন বলেছেন অন্য কথা। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, তানোরের প্রচীন নাম তালড়ি। তাল এবং আড়ি শব্দ হতে তালড়ি নামের উৎপাত্তি। আড়ি শব্দের অর্থ তলা। সুতরাং তালড়ি শব্দের অর্থ তালতলা । বিলকুমারী (শিব) নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই গঞ্জে প্রচুর তালগাছ ছিল। তাই এর নাম তালড়ি। তালড়ির অপভ্রংশ তানোর। অনেকে মনে করেন, একবার প্রবল ঝড়ে শিব ও বিলকুমারী নদীর তীরে প্রচুর তাল উড়ে আসে। তাই এলাকাটির নাম হয় তালউড়ি > তালড়ি। যার অপভ্রংশ তানোর।* তানোর নামের উৎপত্তি নিয়ে হয়তো আরও কোন কিংবদমত্মী লুকিয়ে আছে, যা আমাদের অজানা। তবে তানোর যেভাবেই আসুক না কেন, তানোর তার আপন মহিমাতেই উজ্জ্বল।

তানোরের প্রাচীন ইতিহাস বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা করবার উপায় নেই। কারণ কোন ঐতিহাসিক এ নিয়ে আলোচনা করেননি এবং তানোর সম্পর্কে বিশেষ কোন আলোচনার উলেস্নখও পাওয়া যায় না এখন অবধি। তাই বরেন্দ্রভূমি তানোরকে আলোচনা করেতে গেলে প্রথমে এর পুর্বের ইতিহাস আলোচনা করতে হবে। কারণ পূর্বের ঐতিহাসিক সূত্র ধরেই এখানে আসতে হবে।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্বে’ উলেস্নখ করেছেন, বরেন্দ্রভূমি প্রাচীন পুন্ড্র বা পুন্ড্রবর্ধনেরই এক বৃহৎ অংশ। আবার পুন্ড্র আর বরেন্দ্রকে সমার্থক হিসাবেও দেখিয়েছেন। তিনি অন্য এক স্থানে বলেছেন ‘পুন্ড্রুবর্ধনের কেন্দ্র বা হৃদয়স্থানের একটি নতুন নাম পাইতেছি দশম শতক হইতে; এ নাম বরেন্দ্র অথবা বরেন্দ্রী। ৯৬৭ খৃস্টাব্দের একটি দক্ষিণী লিপিতে ‘বরেন্দ্রদ্যুতিকারিণ’ এবং ‘গৌড়চূড়ামণি’ নামক জৈনক ব্রাহ্মণের উলেস্নখ আছে।’ এতে বোঝা যায় যে, বরেন্দ্রর ইতিহাস ঐতিহ্য আর মাহাত্ম কোন কালেই কম ছিল না।

পুন্ড্ররজনদের সর্বপ্রাচীন উল্লেখ্য ‘ঐতরেয়-ব্রাহ্মণে’ এবং তারপরে ‘বোধায়ন-ধর্মসূত্রে’। এই দুই গ্রন্থেই পুন্ড্ররদের ছোট করে দেখনো হয়েছে। ‘ঐতরেয়-ব্রাহ্মণে’র শুনঃশেপ- আখ্যানের এই উলেস্নখে দেখা যায়, পুন্ড্রররা অন্ধ্র, শবর, পুলিন্দ ও মুতিব কোমদের সংলগ্ন এবং আত্মীয় কোম। এই ধরনের একটি গল্প ‘মহাভারত’র আদিপর্বে আছে। আবার একাধিক পুরানে আছে, পুন্ড্রররা অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ এবং সুহ্মদের ঘনিষ্ট জ্ঞাতি। একটি পুরান মতে, বলি রাজার ক্ষেত্রজ পুত্র ছিল পাঁচজন।  বলি রাজা ছিলেন উর্ধ্বরেতা  আর্থাৎ বলি রাজা সমত্মান প্রজননে সক্ষম ছিলেন না। তাই সমত্মান গ্রহণের ইচ্ছায় বলি রাজার স্ত্রী সুদেষ্ণার  মিলন ঘটে মহর্ষি দীর্ঘতমার সাথে। এর ফলে জন্ম হয় অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্মদ ও পুন্ড্ররর। এরা পরবর্তীতে এক একটি রাজ্যের অধিপতি হন। আর এরা যে রাজ্যের অধিপতি হন তার নামও রাখা হয় সেই রাজার নামানুসারে। কাজেই পুত্র পুন্ড্রর যে রাজ্যের অধিপতি হন, তার নামও হয় রাজার নামানুসারে।একই ভাবে বংগ যে দেশের রাজা হন তার নাম হয় বংগ।  মানবধর্মশাস্ত্রে পুন্ড্ররদের বলা হয়েছে ব্রাত্য ক্ষত্রিয়, যদিও ‘মহাভারত’র সভাপর্বে বঙ্গ ও পুন্ড্রর উভয় কোমকেই শুদ্ধজাত ক্ষত্রিয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এদের নাম অনুসারে পাঁচটি রাজ্যের নাম হয়।

কারো কারো মতে, (যেমন ফরাসী বিশেষজ্ঞ, সিলভ্যাঁ লেভি) অংগ, বংগ, কলিংগ প্রভৃতি নামগুলি এসেছে চীনা পরিবারভুক্ত কোন ভাষা থেকে। দক্ষিণ চীনের ভাষায় ‘কিয়াং’(Kiang) শব্দের অর্থ হল নদী। দক্ষিণ চীনের একটি নদীর নাম হল সি-কিয়াং । সি মানে হল পশ্চিম। সি-কিয়াং মানে হল পশ্চিম দিক থেকে বয়ে আসা নদী। যদিও নদীটা চীনের দক্ষিণে অবস্থিত। নদীটার উদ্ভব হয়েছে উনান মালভূমিতে।  অংগ, বংগ, কলিংগ নামের উদ্ভব ঘটে থাকতে পারে এইসব অঞ্চলের প্রাচীন নদীর নাম থেকে। কারণ কিয়াং শব্দের অর্থ হল নদী। কেননা, সাধারণভাবে এইসব স্থানের নামের সঙ্গে যুক্ত থাকছে ‘য়ং’ ধ্বনি। মনেকরা হয় অতীতে দক্ষিণ চীন থেকে মঙ্গলীয় মানবধারার মানুষ এসে উপনিবিষ্ট হয়েছিল এই সব অঞ্চলে। আর তারা দিয়েছিল এইসব নদীর নাম। চীনা পরিবারের ভাষায় সাধারণভাবেই দেখা যায় যে ‘য়ং’ ধ্বনি নদীর নামের সাথে যুক্ত থাকতে। যেমন, ‘হোয়াংহো’। তিববতী ভাষায় ব্রহ্মপুত্র নদের নাম ‘সাংপো’।  ল্যাপচা ভাষায় তিসত্মা নদীর নাম ‘দিস্তাং’। অনেকে মনে করেন, তিস্তা নদীর নাম হয়েছে সংস্কৃত ‘ত্রিস্রোতা’ থেকে। কিন্তু এই ধারণা যথার্থ নয়। দিস্তাং থেকে বাংলাভাষায় তিস্তা নামের উদ্ভব হতে পেরেছে। এটা হল অধিকাংশ ভাষাতাত্ত্বিকের মত। তবে এখানে উলেস্নখ করা যেতে পারে যে, আমরা বাংলাভাষাতেও চলতি কথায় নদীকে বলি গাং। চীনা পরিবারের ভাষায় আমাদের দেশে রাজবংশী, গারো ও ত্রিপুরীরা কথা বলেন। সম্ভবত এক সময় হয়তো এদেশের অনেক অঞ্চলেই ছিল এদের  মত মঙ্গলীয় মানবধারার মানুষের বাস। যে কারণেই হোক আজ আর তারা টিকে নেই। কিন্তু থেকে গিয়েছে তাদের ভাষাপরিবার থেকে আসা নাম।

 

প্রাচীন হিন্দু যুগে সমগ্র বাংলাদেশের কোন একটি বিশিষ্ট নাম ছেল না। এর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চন ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটা অংশের নাম ছিল বরেন্দ্র। উত্তরবঙ্গে পুন্ড্রর ও বরেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গে রাঢ় ও তাম্রলিপ্তি এবং দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে বঙ্গ, সমতট, হরিকেল ও বঙ্গার প্রভৃতি দেশ ছিল এছাড়া উত্তর পশ্চিমবঙ্গের কতকাংশ গৌড় নামে সুপরিচিত ছিল। তবে এই সমসত্ম দেশের সীশা সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠি, কারণ বিভিন্ন সময়ে এর সীমানা পরিবর্তিত হয়েছে। আসলে প্রাচীন কালে এই ভূখ--র নির্দিষ্ট কোন নাম বা সংজ্ঞা ছিল না। এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে অভিহিত ছিল। এমনকি বঙ্গ আর বঙ্গাল এই দুটি নামই এক সময় দুটি পৃথক দেশের নাম ছিল। মুসলমান যুগেই সর্ব প্রথম এই সমুদয় দেশ একত্রে বাংলা অথবা বাঙ্গালা এই নামে পরিচিত হয়। *১  তাছাড়া সুলতানী আমলে এসে (খৃস্ট্রীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে) ফারসী ভাষায় লিখিত একাধিক ইতিহাস বইতে( যেমন সিরত-ই- ফিরোজশাহী বইতে) পাওয়া যাচ্ছে ‘মুলুক বংগালহ’ নামটি।  এ থেকেই পুর্তগীজ ভাষায় নামটা দাঁড়ায় ইবহমধষধ। আর ইংরেজি ভাষায় ইবহমধষ।

 

ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ‘বঙ্গ’ নামের সঙ্গে ফারসী ‘অহ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে উদ্ভব হয় ‘বঙ্গালহ’ নামটি। এ থেকে মধ্যযুগের বাংলাভাষায় দেশটির নাম দাঁড়ায় ‘বাঙ্গালা’। সম্রাট আকবর তার সাম্রাজ্যকে পনেরটি সুবা বা প্রদেশে ভাগ করেন। যার একটির নাম ছিল ‘বংগালহ’। আবুল ফজল তার ‘আইন-ই-আকবরী’ বইতে লিখেছেন, আগে দেশটির নাম ছিল বংগ’। কিন্তু তারপরে ‘আল’ শব্দটি যুক্ত হয়ে দেশটির নাম দাঁড়ায় ‘বংগাল’। কারণ, এই দেশে মাটি দিয়ে বাঁধ বেধে পানি আটকিয়ে চাষাবাদ করা হয়। এইসব বাঁধকে বলে ‘আল’। আবুল ফজল বলেছেন, সে সময় আকবরের অন্য সুবাগুলির চেয়ে বংগাল ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ। যেখানে খাজনা আদায় করতে বেগ পেতে হত না। অনেকে খাজনা দিত সোনার টাকায়। খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়, কবি মাইকেল মধুসূদন (১৮২৩-১৮৭৩) তাঁর ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের প্রসত্মাবনায় লিখেছেন,

  ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে     মজে লোকে রাঢ়েবঙ্গে

            নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।’

অর্থাৎ কবি মধুসূদনের সময়ও বংগ বলতে প্রধানত বুঝিয়েছে পূর্ব বাংলাকে; পশ্চিম বাংলাকে (রাঢ়) নয়।

তানোরসহ সমগ্র রাজশাহী অঞ্চল এক সময় ছিল পুন্ড্ররুবর্ধন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এই রাজ্যে্র ইতিহাস এখনও অনেকটা অনুদ্ঘাটিত। এই অঞ্চলের প্রামাণিক ইতিহাস হিসাবে পাল শাসনই প্রথম। তাদের সাম্রাজ্য  বাংলা হতে দক্ষিণ বিহার পর্যন্ত বিসত্মৃত ছিল। পালগণ ৭৫০ হতে ১১৫০ খৃস্টাব্দ পর্যমত্ম শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। অত:পর সেনগণ বরেন্দ্র ভূমিসহ এই অঞ্চলে হিন্দু সাম্রাজ্য বিস্তার করেন।*১

বরেন্দ্রীর কেন্দ্রবিন্দু হল বরিন্দের গৈরিক ভূমি যা অনুর্বর আর পুরাভূমি। অবশ্য নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, ‘বগুড়া-রাজশাহীর উত্তর, দিনাজপুরের পূর্ব এবং রংপুরের পশ্চিম স্পর্শ করিয়া এই রেখার একটি বিসত্মৃত স্ফীত উচ্চ গেরিক ভূমি- দেখিতে পাওয়া যায়; ইহাই মুসলমান ঐতিহাসিকদের বরিন্দ্, বরেন্দ্রভূমির কেন্দ্রবিন্দু।’ তবে নীহাররঞ্জন রায়ের এই মত অনুসরণ করলে পুন্ড্রর আর বরেন্দ্রকে সমার্থক ভাবতে হয়। তাই আমরা রাজশাহীর উত্তর ভাগকেই বরেন্দ্র বলে চিহ্নিত করবো। বরেন্দ্র লালমাটির দেশ আর পুরাভূমির দেশ হলেও, এই পুরাভূমির অংশটুকু ছাড়া বৃহত্তর বরেন্দ্র এলাকায় প্রবাহিত নদী এলাকায় রয়েছে জল ও পলিমাটি দ্বারা গঠিত নবভূমি। উপরোক্ত পুরাভূমিরেখাটুকু ছাড়া নবভূমির বাকি সবটাই সমতল-ভূমি, শস্য-ভূমি, যা জলীয় আর শ্যামল। বরেন্দ্রীর বর্তমান অবস্থা এক সময় এমন ছিল না। বরেন্দ্রীর এই গৈরিক পুরাভূমি ছিল অত্যমত্ম জনবিরল। প্রথমে লোক বসতি গড়ে উঠে নদ-নদীর পলি বাহিত সমতল ভূমিতে। তাই দেখা যায় প্রাচীন কালের বরেন্দ্র অঞ্চলের সমৃদ্ধ জনপদগুলি গড়ে উঠেছে নদ-নদী প্লাবিত সমতল ভূমিতে। ‘রামচরিতে’ বরেন্দ্রভূমির শস্যসমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্য্যমন্ডিত যে অঞ্চলের বিবরণ পাওয়া যায়, তা এই সমতল ভূমিই হয়ে থাকবে।

এই বরেন্দ্রভূমি গুপ্তযুগেই একটি সমৃদ্ধ জনপদ হিসাবে পরিচিত লাভ করেছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর বাংলা দেশের ইতিহাস নামক গ্রন্থের প্রথম খ--র চতুর্থ পরিচ্ছেদে বলেছেন ‘আদিম গুপ্তরাজ্য কোথায় অবস্থিত ছিল, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করেন যে, শ্রীগুপ্ত মগধে রাজত্ব করিতেন। কিন্তু চীনদেশীয় পরিব্রাজক ইৎ সিং লিখিয়াছেন, মহারাজ শ্রীগুপ্ত চীনদেশীয় শ্রমণদের জন্য মৃগস্থাপন স্ত্তপের নিকটে একটি মন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন। একখানি বৌদ্ধ গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, মৃগস্থাপন স্ত্তপ বরেন্দ্রে অবস্থিত ছিল।’ জানাব আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর  বরেন্দ্র অঞ্চল বিষয়ক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বর্তমান রাজশাহী জেলার তানোর থানার উত্তরে ধানোরা-বিহারৈল-পাড়িশো এলাকা জুড়ে খৃস্টীয় পঞ্চম শতকে বা তার আগে একটি সমৃদ্ধশালী জনপদ গড়ে উঠেছিল তাতে কোন সেন্দহ নেই। গুপ্ত যুগে এখানে একটি বিরাট আকারের  বৌদ্ধ বিহারের অসিত্মত্ব ছিল। এই নগরী এর আগে থেকেই এখানে অসিত্মত্বশীল ছিল বলে মনে হয়। পরবর্তী কালে গুপ্ত, পাল-বর্মন-সেন যুগেও এ স্থানের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল বলে ধারণা পাওয়া যায়।*২ রমেশচন্দ্র মজুমদার আর একজন  চীন দেশীয় পরিব্রাজকের কথা তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন। পরিব্রাজক বলেছেন, তাঁর সমসাময়িক পূর্ব-ভারতের রাজা দেববর্মা তার রাজ্যে একটি বিশাল বৌদ্ধ মন্দির ছিল। এই মন্দিরটি নালন্দার ২২৮ মাইল পূর্বে অর্থাৎ বঙ্গদেশে অবসিত্মত।*৩ তবে ইন্সক্রিপশান অব বেঙ্গল, অলিউম-৩  -এর নকশা অনুযায়ী এর দুরত্ব হবে ২১৮ মাইল। এবং সে অনুসারে এই বৌদ্ধ মন্দিরটি হবে বিহারৈল বৌদ্ধ মন্দির। আর এ কথা বলবার আর একটি কারণ হল, এ ক্ষেত্রে এই বিহারটি সোমপুর বা জগদ্দল মহাবিহার হবার সম্ভাবনা নেই। কারণ, সোমপুর বিহার নির্মিত হয় অষ্টম শতাব্দিতে রাজা ধর্মপাল(৭৭০-৮১০ খৃ) কর্তৃক। আর জগদ্দল বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়  একাদশ শতকের শেষে অথবা দ্বাদশ শতকের গোড়ার দিকে নরপতি রামপালের আনুকূণ্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায়।*৪ এছাড়া নালন্দা থেকে এ দুটি বিহারের দুরত্ব উপরে উলেস্নখিত দুরত্বের কাছাকাছিও নয়। এ থেকে আমরা বলতে পারি যে, রাজশাহীর উত্তরাংশ অর্থাৎ বরেন্দ্রীর এই তানোর সপ্তম শতকে ছিল রাজা দেববর্মার অধিনে। রাজা দেববর্মা ছিলেন খড়গ্বংশীয় রাজা। আর এই বংশের রাজারা নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবি করতেন। অর্থাৎ নিজেরা ছিলেন যোদ্ধা জাতি। মহাকবি কালিদাস তাঁর ‘রঘুবংশ কাব্যে’ পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদেরকে সুহ্ম বা রাঢ় অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের তুলনায় বীর ও সাহসী বলে উলেস্নখ করেছেন। তবে মোটের উপর বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ যে সাহসী আর সৌর্যেবীর্যে যোদ্ধা মনস্ক, তার প্রমাণ অনেক ক্ষেত্রে তারা রাখতে সক্ষম হয়েছে। প্রাচীন যুগেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। প্রাচীন কালে রাজশাহীর প্রাণকেন্দ্র বলতে যা বোঝাত, তা ছিল পাড়িশো-বিহারৈল-ধানোরা। তখন এই নগর রাজশাহীর কোন অসিত্মত্বই ছিল না। বরেন্দ্রর এই অঞ্চলের নগর সভ্যতার সূত্রপাত হয়েছে পাড়িশো-বিহারৈল-ধানোরাতে। এই সভ্যতার সূত্রপাতকারীরা ছিলেন অনেক সৌর্যবীর্যবান। যার প্রমাণ মিলে তাদের রণকৌশল প্রশিক্ষণের জন্যে ‘দমদমা’ নির্মাণ দেখে। দমদমা হল আরবি শব্দ। যার অর্থ হল- ধনুর্বাণ, বন্দুক ইত্যাদির দ্বারা যুদ্ধকৌশল অভ্যাস করবার জন্যে নির্মিত মাটির স্ত্তপ বা চাঁদমারির জন্যে তৈরি মাটির ঢিবি। চাঁদমারি অর্থাৎ ধনুর্বাণ, বন্দুকের গুলি ইত্যাদি ছোঁড়া অভ্যাসের জন্য স্থাপিত চন্দ্রাকৃতি লক্ষ্যস্থল বা নিশানার নিদর্শন। পাড়িশো-বিহারৈল-ধানোরার পাশেও ছিল এমন একটি দমদমা। এটি শিব নদের কূলে আর কামারগাঁ থেকে দেড় কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এই দমদমাটি এখন দমদমা নামক গ্রামে পরিণত হয়েছে। প্রকৃত প্রসত্মাবে প্রাচীন দমদমা নেই ঠিকই, কিন্তু সেই নামের ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে গ্রামটি।

তানোরের অতীত ইতিহাস অনেক গৌরবজ্জ্বল ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। বিশেষ করে পাল যুগ এবং এর পূর্বের ইতিহাস সে কথাই বলে। সেন আমলে (১০৯৫-১২২৫) তানোরের বিশেষ কিছু শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল বলে বলে মনে হয় না। কারণ তার কোন নিদর্শন আমরা দেখতে পাই না। অবশ্য প্রথম দিকে সেন রাজারা পাল রাজার অধিনস্থ অর্থাৎ সামমত্ম রাজা ছিলেন। যেমন বিজয়সেন ১০৯৫ অব্দে সিংহাসন আহরণ করেন (অবশ্য তাম্রশাসনোক্ত রাজ্যাঙ্ক ৩২ পাঠ করলে তিনি আনুমানিক ১১২৫ খৃস্টাব্দে সিংহাসন আহরণ করেন), আবার পাল রাজা রামপাল ১০৭৭ থেকে ১১৩০ পর্যমত্ম রাজত্ব করেন। এ থেকে অনুমান করা চলে, রাজা বিজয়সেন প্রথম দিকে রামপালের সামমত্ম রাজা ছিলেন। অনেকের মতে যে সমসত্ম সামমত্ম রাজা রামপালকে বরেন্দ্র উদ্ধারে সাহায্য করেছিলেন, তাদের মধ্যে বিজয়সেন অন্যতম। আবার রামপালের মৃত্যুর পরে পাল রাজ্যে গোলযোগ উপস্থিত হলে তখনই বিজয়সেন তার শক্তি বৃদ্ধি করেন। এই অঞ্চলও বিজয়সেনের রাজত্বের অংশ ছিল। অনেক প--তের ধারণা বিজয়সেনের রাজধানী ছিল রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার বিজয়নগর গ্রাম। এই গ্রামই প্রাচীন বিজয়পুর। যদিও ঐহিহাসিক সত্য বলে অনেকে মনে করেন ভারতের নদীয়াই হল প্রাচীন বিজয়পুর। তবে তানোরের ইতিহাসের সঙ্গে সেন রাজত্বের বিশেষ কোন কীর্তিগাঁথা নেই। তারপরেও তানোর থেকে সেন আমলের বেশকিছু কৃষ্ণপাথরের মূর্তি পাওয়া গেছে। এ থেকে অনুমান করা চলে, তানোরে হিন্দু সংস্কৃতির চর্চা একেবারেই কম ছিল না। একথা ঠিক পাল রাজাদের বাংলাভাষাভাষিরা যেভাবে আপন বলে মনে করতেন, অন্য কাউকে অতটা আপন বলে কোনদিনই মনে করেননি। কারণ সেনবংশের রাজ্যশাসনের ইতিহাস বর্ণবাদের ইতিহাস। এখনে জাতিভেদ প্রথা খুব প্রকট হয়ে উঠেছিল। সেনরাজবংশের কথা নীহাররঞ্জন রায় কিছুটা আলোকপাত করেছেন। তাঁর ভাষাতেই এখানে কিছু বলবার সুযোগ আছে। তাঁর বর্ণনায়- সুদীর্ঘকাল রাজত্ব এবং রামপাল-পরবর্তী বাঙলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভগ্নদশার সুযোগ লইয়া পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজধিরাজ বিজয়সেনই বাঙলায় সেনবংশের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। পরস্পর ঈর্ষাপরায়ণ ও বিবদমান সামমত্ম নরপতিদের অন্ধ রাষ্ট্রবুদ্ধিতে আচ্ছন্ন ও ক্লিষ্ট বাঙলাদেশ পরাক্রামত্ম রাজবংশ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় শামিত্ম ও স্বসিত্ম লাভ করিল বটে; কিন্তু এ কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই রাষ্ট্র ও রাজবংশ বাঙলার ও বাঙালির নয়।... .... - সমসাময়িক বাঙালী জনসাধারণ এই রাজবংশকে আপনার জন বলিয়া মনে করিয়াছিল, এমন কোনও প্রমাণ বা ইঙ্গিত কোথাও পাওয়া যায় না। গোপাল বাঙালী ছিলেন, পালবংশের পিতৃভূমি বাঙলাদেশ; সেই হিসাবে পাল রাজারা যতটা বাঙালী জনসাধারণের হৃদয়ের নিকটাবর্তী ছিলেন, সেন-রাজারা তাহা হইতে পারেন নাই। তারনাথের আমলে যে-ভাবে গোপাল নির্বাচনের কাহিনী লোকস্মৃতিতে বিধৃত ছিল, ধর্মপালের যশ যেভাবে দোকানে-চত্বরে, জনসাধারণের কণ্ঠে গীত হইত, মহীপাল- যোগীপাল- ভোগীপালের গানের স্মৃতি ভোবে বাঙালী জনসাধারণ আজও ধারণ করে, বহুদিন পর্যমত্ম লোকে যেভাবে ধান ভানতে মহীপালের গীত’ গাহিত, বলস্নালসেন ছাড়া সেন রাজাদের কাহারও সে সৌভাগ্য হয় নাই। এই তথ্যের ঐতিহাসিক ইঙ্গিত অবহেলার জিনিস নয়। সেনরাজাদের মহিমা যাহা যতটুকু গীত হইয়ছে তাহা সভাকবিদের কণ্ঠে......। গোপাল বা ধর্মপাল- দেবপাল-মহীপালের সঙ্গে বিজয়-বল্লাল-লক্ষ্মণের তুলনা নিরর্থক এবং অনেতিহাসিক। পালবংশকে বাঙালী ভালবাসিয়াছিল এবং তাহাদের গৌরবকে নিজেদের জাতীয় গৌরব বলিয়া মানিয়া লইয়াছিল; ......। একটি লোকগীতিও সেন-রাজাদের কাহারও নামে রচিত হয় নাই; বঙলা সাহিত্যে লোকস্মৃতিতে সেন-রাজারা বাঁচিয়া নাই।*৫ নীহাররঞ্জনও সেনরাজবংশকে বাংলা ও বাঙালির বলে মনে করেননি। আসলে সেনপর্বের বাংলার সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী ধর্মই ছিল ব্রাহ্মাণ্য ধর্ম এবং সেই ব্রাহ্মাণ্য ধর্ম বেদ ও পুরাণ, শ্রুতি ও স্মৃতিদ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত এবং তন্ত্রদ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিল। নীহাররঞ্জন এও বলেছেন যে, এই দেড়শত বছর বাংলার আকাশ একামত্মই ব্রাহ্মাণ্য ধর্মের আকাশ ছিল। এসময় জৈনধর্মের চিহ্নমাত্র কোথাও দেখা যায়নি। বজ্রযানী, সহজযানী বা কালচক্রযানী বৌদ্ধরা কোন ধর্মাচরণানুষ্ঠান করলেও তা গোপনে করতেন। তাদের দেবদেবীর মূর্তি তখন প্রায় বিরল। বৌদ্ধবিহারগুলিরও তখন বেহাল দশা। বৌদ্ধরা এ সময় বহু দেবদেবীর মূর্তি গড়ে পূজা করলেও হিন্দুরা বৌদ্ধদের ঘৃণা করতেন। বলতেন পাষ-। বৌদ্ধরা ধর্মের দিক থেকে ছিলেন অনেক উদার। তারা হিন্দু দেবদেবীদেরকেও সম্মান করেছেন। তাদের বিহারগুলোরে দেয়ালে উৎকীর্ণ শতশত হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিই তার প্রমাণ। কিন্তু গোঁড়া হিন্দু সেন রাজাদের রাজত্বের সময় বৌদ্ধদের উপর করা হয় বিশেষ অত্যাচার। সৃষ্টি হতে পারে হিন্দু -বৌদ্ধ বৈরীতা। বাংলায় বৌদ্ধদের দলে দলে ইসলাম গ্রহণের একটি কারণ, সেন রাজাদের রাজত্বকালে হিন্দুদের দ্বারা বৌদ্ধদের উৎপিড়ন।

আসলে বৌদ্ধরা তখন তাদের এই বেহাল দশা থেকে উৎড়িয়ে উঠবার জন্য চাচ্ছিলেন একজন ত্রাণকর্তা। যারা তাদের দিবে স্বাধীনতা। আসলে হিন্দুধর্মের নিচু শ্রেণির বা বর্ণে লোকেরাও এমনটিই চাচ্ছিল। কারণ তারা তখন ছিল যথেষ্ট ম্লেচ্ছ আ অচ্ছুত।

বৌদ্ধরা তুর্কি মুসলমানদের ভেবেছিলেন গৌতমবুদ্ধ কর্তৃক প্রেরিত ত্রাণকর্তা হিসাবে। এ সময়ে বাংলাদেশের বৌদ্ধরা মনে করতেন, গৌতমবুদ্ধ মারা যাবার পর স্বর্গে বা বৈকুণ্ঠে আদি চিরমত্মন বুদ্ধ হিসাবে বাস করছেন। পশ্চিমবংগে ‘ধর্মপূজা বিধান’ বলে একটি বই পাওয়া গিয়েছে। তাতে ‘নিরঞ্জনের রূস্মা’ বলে একটি কবিতা আছে। যাতে বলা হয়েছে-

মনেতে পাইয়া মর্ম    সভে বলে রাখ ধর্ম

       তোমা বিনে কে করে পরিত্রাণ।

এইরূপে দ্বিজগণ   করে সৃষ্টি সংহরণ

       এ বড় হইল অবিচার।

ভক্তদের প্রার্থনা শুনে বৈকুণ্ঠে (স্বর্গে) ধর্মঠাকুরের (বুদ্ধের) আসন টলে উঠে:

বৈকুণ্ঠে থাকিয়া ধর্ম   মনেতে পাইয়া মর্ম

          মায়ারূপে হইল খনকার।

ধর্ম হইলা যবনরূপী   শিরে নিল কাল টুপি

          হাতে শোভে ত্রিকচ কামান।

যতেক দেবগণ   সবে হয়ে একমন

     আনন্দেতে পরিল ইজার।

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, পাল রাজাদের রাজত্বের সময় বাংলায় অনেক বৌদ্ধ ছিলেন। সেন রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রাধান্য পুনপ্রতিষ্ঠিত করেন। তার ফলে অনেক প্রাক্তন বৌদ্ধ, সমাজের নিম্নসত্মরে পতিত হন। তারা মুসলমানদের ত্রানকর্তা বলেই ভেবেছিলেন। তাদের বিশ্বাস হয়েছিল যে, ব্রাহ্মণদের অত্যাচার বন্ধ করবার জন্যে দেবতারা মুসলমানদের মূর্তিতে ভূতলে অবতীর্ণ হয়েছেন। উপরের কবিতাটি কোন সময়ের রচনা তা সঠিক জানা যায় না। ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে সমাজের নিম্নশ্রেণিভুক্ত প্রাক্তন বৌদ্ধগণ মুসলমাকেই হিন্দু উপাস্য দেবতার স্থানে বসিয়েছিল অর্থাৎ তার যে সবাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, উপরের কবিতায় তাই ধ্বনিত হয়েছে।*

 

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে বরেন্দ্রঅঞ্চলে অনেক মহাযান বৌদ্ধের বাস। এইসব বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণ করে হয়ে পড়েন মুসলিম সমাজের অংশ। এখানে উলেস্নখ করা যেতে পারে যে, কেবল বাংলাদেশ নয়, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়াতেও দলে দলে মহাযান বৌদ্ধরা গ্রহণ করেন ইসলাম। বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এখন বাস করেন সর্বাধিক সংখ্যক মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ। বাংলাদেশে মধ্য এশিয়া থেকে ১২০৪ খৃস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খালজী নদীয়ার লক্ষণ সেনকে বিতাড়িত করে এই অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতে বাইরে থেকে কোন মুসলিম শক্তি যেয়ে রাজত্ব বিসত্মার করেননি। এখানে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে অত্যমত্ম শামিত্মপূর্ণভাবে। কোন প্রকার তরবারির সাহায্য ছাড়ায়। ইসলামের এই বিসত্মার যথেষ্ট বিস্ময়কর। ইসলামধর্মে এমন কিছু আছে যা এই অঞ্চলের মানুষকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

তানোরের ইতিহাস আলোচনায় মধ্যযুগকে আনতে গেলে পুরো বাংলার ইতিহাসকে টানতে হবে। কারণ, বিক্ষিপ্তভাবে তানোরের উপযোগী করে আলোচনার কিছু নেই। এই আলোচনা করতে গেলে বাংলায় মুসলমান রাজ্যের বিসত্মার, ইলিয়াসশাহী বংশের বিসত্মার, রাজা গণেশ ও তার বংশ, মাহমুদশাহী বংশ, হোসেনশাহী বংশ, এরপর মুঘল যুগেরও আলোচনা করতে হবে। এতে বই পা--ত্যের ভারে ভারাক্রামত্ম হতে পারে। আমার উদ্দেশ্যও তাই নয়। আমি আগেই বলেছি, এই গ্রন্থ সাধারণ জিজ্ঞাসু ব্যাসত্ম পাঠকের জন্যে। যার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন, বা করবেন, তারা ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন। তবে বাংলার বিশেষ করে উত্তর বাংলার রাজ্য শাসনে দুজনের নাম চির স্মরণীয় হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। তাঁরা হলে রাজা গণেশ ও তার পুত্র জালালউদ্দিন মুবারক শাহ (যদু)।

সুলতানী আমলের বিশেষ কোন কীর্তি বা  ইতিহাসের যুক্তি পেতে পারে তার বিশেষ কিছু এখন আর তেমন নেই। পূর্বে ছিল এমন আলোচনাও কোন ঐতিহাসিক করেননি। তাবে পাড়িশো গ্রামের উত্তর ধারে নির্মিত দরগা যা কতকটা তাজিয়ার মত, এই স্থাপত্য শিল্পে দেখা যায় সুলতানী আমলের নিদর্শনের ছাপ। কারণ এর গায়ের নকশাকলা ও পোড়ামাটির ফলকের ধরণ দেখে অনুমিত হয়, এটি সুলতানী আমলে নির্মিত হয়েছে। এর সম্পর্কে আলোচনা অন্য একটি পরিচ্ছেদে বিসত্মারিত আছে।

১৩৩৮ খৃস্টাব্দ পর্যমত্ম দিলিস্নর নামমাত্র আনুগত্যে এই অঞ্চল এক রকম স্বাধীনভাবেই শাসিত হতে থাকে। ফখরম্নদ-দীন মুবারক শাহ প্রথম বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে এই অঞ্চলে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন (১৩৩৮ খৃ)। মুঘল আমলে এই অঞ্চল কতকগুলি চাকলায় পৃথক পৃথক হিন্দু জমিদারের অধীনে ছিল। তবে পরে বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ এই অঞ্চলের উপর দেওয়ানী লাভ করে। সুলতানী আমলে বিভিন্ন পীর দরবেশ ও আউলীয়ার আগম ঘটে বাংলার উত্তর জনপদে। ইসলামধর্ম বিসত্মারই হয়ে উঠে তাদের মূল লক্ষ্য। এর জন্য তারা বিভিন্ন নির্জন এলাকায় গড়ে তোলে তাদের আসত্মানা। যেমনটি ইংরেজ আমলে আমরা দেখেছি পুর্তগিজ খৃস্টান মিশনারীদের ক্ষেত্রে। যাইহোক, এই সমসত্ম পীর আউলিয়ারা তাদের আসত্মানা কোন স্থাপত্যের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেননি। তবে তাদের ভক্তেরও অভাব হয়নি। এরা বিশেষভাবে মুঘল আমলে এই এলাকায় বিসত্মার লাভ করেন। অর্থাৎ সাড়ম্বরে আসত্মানা গাড়তে সক্ষম হন। হাতে পারে তা তাদের সাগরেদ বা  ভক্তদের অর্থায়নে কিংবা উচ্চ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় ছোট ছোট আসত্মানা বা ইমারত নির্মাণ করেন, যা এক গুম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের মত । এ মসজিদের দরজা একটি এবং খুব ছোট আকৃতির। ভেতরে দাঁড়ালে বড়জোর ছয় থেকে আটজনের এক সাতে নামাজ আদায় করা যেতে পারে। মসজিদগুলি আকারে ছোট হলেও এর নির্মারের ভিত অনেক মজবুদ। এর দেওয়াল চওড়ায় প্রায় চার ফিট। এর ডান অথবা বাম ধারে থাকতে দেখা যায় ছোট অথচ সুদৃশ্য এক বা একাদিক বাতিঘর। তবে মসজিদগুলো যে কোন দক্ষ নির্মান শিল্পীর হাতের তৈরি এতে কোন সন্দেহ নেই। তানোরে এরকম একগুম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ পাওয়া গেছে তিনটি। একটি রয়েছে ইলামদহ গ্রামের পূর্বপাড়ায়, দ্বিতীয়টি রয়েছে গকুল গ্রামের উত্তরে প্রাক্তন রাহাতুলস্না চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে এবং তৃতীয়টি আছে মুহাম্মদপুর গ্রামে। এরপরে মুঘল ঐতিহ্যের দুইটি তিন গুম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ এখনও স্বগৌরবে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে তানোরের ভাগনা  ও মু-ুমালায়। মসজিদ দুটির কারম্নকাজ এখনো দর্শনার্থীর মন কাড়ে। এরপরে আমাদের বিশ্মিত করে কালিগঞ্জের রাইতনবড়শো মৌজার মসজিদটি। এটি প্রস্থে কম হলেও লম্বায় অন্য দুটির সমান অথবা কিঞ্চিৎ বড় হবে। তবে মসজিদটি ঝোপজঙ্গলের আড়ালে তার ঐতিহ্যগাঁথা হারাতে বসেছে।

ইংরেজ আমলে হিন্দু জমিদারদের দাপট আর ক্ষমাতার কথা সবার জানা। তানোরও এর ব্যতিক্রম নয়। জমিদারদের কথা বলতে গিয়ে একটি প্রবাদের কথা মনে এলা: সাপ,  শালা, জমিদার, কেউ নয় আপনার।  উক্ত প্রবাদে যাদের অত্যাচারের কথা বলা হয়েছে, তা নিশ্চয় সামাজিক অভিজ্ঞতার ফল। তবে সব শালা এবং সব জমিদার নিশ্চয়ই এক রকম নয়। অত্যাচারী জমিদার অনেকেই ছিল। তাই বলে প্রজাহিতৈষী যে  দু একজন ছিলেন না, তা হতে পারে না। তানোরে যে বজন রাজা বা জমিদার ছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন প্রজা দরদী। এ বিষয়ে তাঁদের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। এই রাজাদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলেন: ললিত মোহন মৈত্র, কিশোরী মোহন চৌধুরী এবং ধরণী মোহন চৌধুরী রায় বাহাদুর। এছাড়া আরো যারা আছেন, তারা হলেন- নৃপেন্দ্রনাথ রায়, ব্রজমোহন রায় চেধৈুরী, ........, .................. ,। এই রাজা বা জমিদারদের সম্পর্কে বিসত্মারিত আলোচনা আছে অন্য এক অধ্যায়ে। তাই বিসত্মারিততে গেলাম না। আর এখানেই তানোরের ইতিহাসের আদিপর্ব শেষ করছি। আশা কারি তানোর সম্পর্কে পাঠকের জানবার আগ্রহ তীব্র হবে।

_______________________________

*১  Legend and History of Tanore: Narayan Chandra Biswas. Publisher- Anita Biswas. Gollapar, Tanore, Rajshahi. 2012.

*২  ড. মোহাম্মদ আমীন: জেলা উপজেলা ও নদ-নদীর নামকরণের ইতিহাস। পৃষ্ঠা- ১৬২। গতিধারা, ঢাকা ২০১২।

*১*১ রমেশচন্দ্র মজুমদার: বাংলা দেশের ইতিহাস। প্রাচীন যুগ।

*১ ** ইসলামী বিশ্বকোষ: ১২শ খ-, পৃষ্ঠা-১৭৮। ১৯৯২।

*২ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া: বাংলাদেশের প্রত্ন-সম্পদ। গতিধারা প্রকাশন, ঢাকা- ২০০৭।

*৩. রমেশচন্দ্র মজুমদার: বাংলা দেশের ইতিহাস। প্রাচীন যুগ।

*৪ নীহাররঞ্জন রায়: বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্ব

*৫ ঐ । সেনরাজবংশ কথার সামাজিক অর্থ।

*৬ রমেশচন্দ্র মজুমদার সস্পাদিত বাংলা দেশের ইতিহাস (দ্বিতীয় খ-), পৃষ্ঠা-১৬৭; পঞ্চম সংষ্করণ- মার্চ ১৯৯৮। জেনারেল প্রিন্টার্স, কলকাতা।